content
stringlengths 0
129k
|
---|
আমার এই আতান্তরে মেয়েটি বোধকরি ভিতরে ভিতরে বেশ মজা পেয়ে থাকবে |
একটা দমকি হাসি হেসে বললোঃ |
'আপনি নিশ্চয়ই সাদমান ভাই? আমি শিরিন |
মমিন সাহেবের স্ত্রী |
আপনার কথা বলেছেন উনি' |
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম |
হঠাত কি বলবো, খুঁজে পেলাম না |
গলা খসখস করছে |
পঞ্চাশোর্দ্ধ মমিনের এই বউ থাকাটা অষ্টম আশ্চর্যের ঠেকলো! কিন্তু এটা তো হতেই পারে - অস্বাভাবিক কিছু নয় - গ্রাম দেশে এমনটা অহরহই ঘটে থাকে! অথচ তখন আমার মমিন ভাইকে খুব খারাপ মনে হয়েছিলো |
আর একটা গনগনে ঈর্ষা! |
দ্রুত সামলে নিলাম আমি |
এসব কী ভাবছি? ভদ্রমহিলা মমিন ভাইয়ের স্ত্রী |
মমিন ভাইয়ের কাছে আমি আজন্মের ঋণী - কীভাবে এই কুচিন্তা আসে আমার মনে? নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে বাস্তবে ফিরে আসি |
একটু গলাটা পরিষ্কার করে, |
'আসলে মাফ করবেন এই ভর দুপুরে জ্বালাচ্ছি বলে |
মমিন ভাই বলেছিলো আসতে...' আমার গলাটা নিশ্চয় আধাভাঙ্গা ফ্যাসফ্যাসে শুনিয়ে থাকবে |
মেয়েটা যেন আরো আনন্দ পেয়ে যায় |
হাসতে হাসতেই বলে, |
'সেটা তো গত শুক্রবারের কথা |
আপনি এলেন না; বেচারা খুব মন খারাপ করেছিলো' |
'আমার ভুলামন ভীষণ...সত্যিই তো, খুব খারাপ হয়েছে কাজটা |
আজকেই মনে পড়েছে |
আর কিছু না ভেবেই চলে এসেছি!' |
'হ্যাঁ, উনি তো আর জানেন না |
নবাবের হাঁটে গিয়েছেন - আসতে রাত হবে অনেক' |
'ও, আমি তাহলে উঠি আজকে |
বলবেনঃ আগামিকাল আসবো' |
আমার এই তাড়ায় শিরিন ব্যস্ত হয়ে ওঠে |
'সে কী করে হয়? প্রথম এলেন আমাদের গরিবখানায় |
এমনি তো যেতে দিতে পারি না - উনি রাগ করবেন |
বসেন, আমাকে ঘন্টাখানেক সময় দেন' বলেই বের হয়ে যায় শিরিন |
আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না - আশ্চর্য মেয়ে! এইমাত্র পরিচয় অথচ মনে হচ্ছে কতদিন ধরে চিনি! খানিকটা পায়চারি করে কাঠের শিকের জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম |
দিনের আলো নিভে এসেছে -সূর্য ডুবছে |
না, ভুল হলো |
আকাশে মেঘ করেছে - কালবৈশাখী সম্ভবত |
তখনি মেঘের গুড়গুড়ানি শুনতে পেলাম |
শিরিনের ছুটাছুটির কোনো কমতি নেই তাতে |
আঁচলটা কোমরে গুঁজে ইয়া বড় একটা মাছ নিয়ে উঠানের একপাশে কাটতে বসেছে |
ফর্সা মুখে পাশের চুলার আগুনের আঁচ লেগে আছে |
কানের গোঁড়া থেকে হালকা কোঁকড়ান কিছু অবাধ্য চুল গালে এসে পড়েছে |
প্রতিটা নড়াচড়া, কমনীয় ভঙ্গি আমাকে নিষিদ্ধ এক সুখে পাগল করে দিতে থাকে |
আমার এই দীর্ঘ ব্যাচেলর জীবনে এই প্রথম সত্যি সত্যি কাউকে বড় একান্তে পেতে ইচ্ছে করে বসে! |
জানালা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি |
সময় যেন থেমে থাকে অসম্ভব একটা প্রাপ্তির মিথ্যা হাতছানিতে |
একে না পেলে আমার বাকী জীবনটা বৃথাই হয়ে যাবে |
কিন্তু এ যে অন্যায়! আমার কামনার অন্ধ পশুটি অবশেষে বিবেকের কাছে একটা চাবুক খায় |
কাছে কোথাও কড়াত শব্দে একটা বাজ পড়ে |
আমার আবার মনে পড়ে যায় সেই বিশ বছর আগের কাহিনি |
মমিন ভাই আমাদের বাড়িতে জায়গীর থেকে আমাকে পড়াতেন |
ভীষণ স্নেহ করতেন |
আমার নানান দুষ্টামির কারণে বাবার গাধা পেটানোর রাগটা প্রায় সময় মমিন ভাইই পিঠ পেতে নিতেন |
সবসময় বলতেনঃ চাচা, ছেলেমানুষ - কী বুঝে? মাফ করে দেন |
এই আশকারাতে কিনা আমি প্রায় উচ্ছন্নে চলে গেলাম |
আজেবাজে বখাটেদের সাথে ভাব হয়ে গেলো বেশ |
ওদেরই প্ররোচনায় একদিন দাদুর টাকা মেরে শহরে কিছুদিন ফুর্তি করার একটা আইডিয়া মাথায় আসে |
বোকা আমি; ঠিক-বেঠিকের কোনো জ্ঞান ছিলো না |
দাদুর যক্ষের ধন অনেকগুলো টাকা খাট-কাম-সিন্দুক হতে মেরে দিয়ে রাতের আঁধারে পালাতে গিয়েছিলাম |
কিন্তু গুবলেট করে ফেলি |
পালাতে গিয়ে প্রায় ধরা পড়তে গেলে মমিন ভাইকে সামনে পেয়ে যাই |
আহ, সেদিনের কথা এখনও ভালো মনে আছে |
বেগতিক দেখে গোবেচারা মমিন ভাইকে সব টাকা দিয়ে দ্রুত কেটে পড়ি |
মমিন ভাই, আহ বেচারা টাকাগুলো নিয়ে আমার বাঘ বাপের হাতে ধরা পড়ে যায় |
তারপরের ঘটনা মনে করতে চাই না |
যে অপমান, হেনস্থা, মারপিট গেলো...মমিন ভাই কিচ্ছু বললেন না |
শুধু বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন সবাইকে |
কিন্তু কেউ কথা শোনেনি |
গরিবের মূল্যই নাই কোনো! শেষে অবশ্য থানা-হাজত হয় না |
দাদু মারপিটেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান ব্যাপারটা |
দড়ি দিয়ে সারারাত বেঁধে রাখা হলো তাকে |
সেইরাত আমি ঘুমাতে পারিনি - সারারাত বাচ্চাছেলের মত কাঁদলাম |
প্রতিজ্ঞা করলামঃ ভালো হয়ে যাবো |
আমার জন্য মমিন ভাইয়ের এই ত্যাগকে সম্মান জানাবো |
শেষরাতে চুপি চুপি দড়ির বাঁধন খুলে দিয়ে তার পা ধরে মাফ চাইলাম |
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত ঠোঁটে কষ্টে একটা হাসি দিয়ে বললেন, 'মানুষ হ! তোর প্রতি আমার কোনো রাগ নাই রে!' |
পরদিন তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না |
সে নিরুদ্দেশ হয়েছে চুরির অভিযোগ মাথায় নিয়ে, দুঃখে, অভিমানে |
সেই মমিন ভাইয়ের স্ত্রীকে নিয়ে কীভাবে সে এরকম ভাবতে পারলাম? নিজের প্রতি একটা ঘেন্না চলে আসে |
জানালায় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, জানি না |
হঠাত সম্বিৎ ফিরে আসে একটা চিকন মধুর কণ্ঠে, |
'এভাবে ভূতের মত দাঁড়ায় আছেন কেন? ঝড় হচ্ছে তো, ভিজে যাচ্ছেন |
সরে দাঁড়ান |
জানালা বন্ধ করবো' বলেই মেয়েটা এগিয়ে আসে |
ওর ঘাড়ের কাছটা অসাবধানে লেগে যায় আমার বুকে |
অল্প একটু ছোঁয়া কিন্তু মনে হলো হাজার ভোল্টের একটা শক খেলাম |
অতি সাবধানী হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম, |
'কেন?' শিরিনের মুখে একটা অদ্ভুত কৌতুক হ্যারিকেনের আলোতে খেলা করছে |
আমি কী বলবো, খুঁজে না পেয়ে আমতা আমতা করতে লাগলাম |
শিরিনের হাসিটা আরো বিস্তৃত হলো |
যেন আমার ভেতরের লোভিটাকে ঠিক চিনে নিয়েছে! কী বিপদে পড়া গেলো? কী চায় কী এই মেয়ে? সর্বনাশ না করে দেখি ছাড়বে না! |
'আসেন, খেতে আসেন |
রান্না করেছি' |
'মমিন ভাইয়ের জন্য একটু অপেক্ষা করি?' |
'বললাম না, ওনার আসতে দেরী হবে |
তাছাড়া এই ঝড়বাদল...মনেহয় আপনিও যেতে পারবেন না' দাঁতে ঠোঁট চেপে একটা মাদক হাসি হাসতে থাকে |
সেটা ঠিক হবে না |
লোকে কী বলবে? গ্রামদেশ এটা... আমি ঠিকই চলে যেতে পারবো' আমি একটু জোরের সাথেই বলে ফেলি - কিছুটা উচ্চস্বরে |
'আরে বাবা, ঠিক আছে |
কে আটকাচ্ছে আপনাকে? চলেন, চলেন...খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে' আবারও মৃদু হাসি লেগেই থাকে |
কিছু বাধা অ-পেরোনোই থাক |
তৃষ্ণা হয়ে থাক কান্না-গভীর ঘুমে মাখা |